সুলতান আলা-উদ-দ্বীন মুহাম্মাদ শাহ্‌'র মেবাড় বিজয়

প্রারম্ভিকা
যেহেতু এই ব্যাপারটা নিয়ে লিখতে গিয়েই আমি রিপোর্ট খেয়েছি, তাই এবারে সুলতান আলা-উদ-দ্বীন মুহাম্মাদ শাহ্‌ খাল্‌জীর মেবাড় বিজয় নিয়ে বিস্তারিত ভাবেই লিখা শুরু করলাম। আমি যা লিখছি- তা বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও আমার, তাই কিঞ্চিৎ বেশি ব্যাখ্যা ও অন্যান্য ঘটনাও এখানে তুলে ধরা হবে- যাতে সবাই বুঝতে পারেন। চিন্তা করে দেখলাম এক কল্পনাবিলাসী জাতীর রঙীন স্বপ্নের তৃপ্তি ও ১ নির্বোধ পরিচালকের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রমাণ দাড় করানোর চেয়ে মেবাড় বিজয়ের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরাটাই শ্রেয়, তাই বিস্তারিত ভাবে শুধু মেবাড় বিজয়ের ঘটনাবলিই তুলে ধরছিঃ
সুলতান আলা-উদ-দ্বীন খাল্‌জী সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে ১ম কারাহ্‌ প্রদেশের শাসনভার প্রাপ্ত হন ১২৯০ ঈসায়ীতে। সুলতান বাল্‌বানের ভাগ্নে ও কারাহ্‌'র সাবেক শাসনকর্তা মালিক সাজ্‌জ’র বিদ্রোহ দমন করার পুরষ্কারসরুপ আলা-উদ-দ্বীন কারাহ্‌’র শাসনভার প্রাপ্ত হন। তিনি উচ্চাভিলাষী সামরিক অভিযাত্রী ছিলেন, বিধায় চাচার অনুমতিক্রমে প্রথমেই তিনি ১২৯২ ঈসায়ীতে মালব আক্রমণ করেন ও এর রাজধানী বিদিশা(ভিলসা) পর্যন্ত অধিকার করে নেন! ৭,০০০ ঘোড়া ও অগণিত গানীমাহ্‌ নিয়ে তিনি ফিরে এলে সুলতান ফিরুয শাহ্‌ খাল্‌জী পুরষ্কারসরূপ অযোধ্যা প্রদেশটিকেও আলা-উদ-দ্বীনের শাসনাধীনে দিয়ে দেন। ১২৯৫ সালে দাক্ষিণাত্যের সুবিশাল যাদব রাজ্যের রাজা রামচন্দ্র দেবের পুত্র শঙ্কর দেবকে মাত্র ৬,০০০ সৈন্যসহ শোচনীয় ভাবে পরাজিত করে বেরার ও গোন্দ্‌ওয়ানা অধিকার করেন। এবং ৬০০ মণ সোনা, ১,০০০ মণ রুপা, ৭ মণ মুক্তা, ২ মণ মূল্যবান হাতী, ৩০০ হাতী ও কয়েক হাজার ঘোড়াসহ কারাহ্‌ ফিরে আসেন(তারিখ-ই-ফিরুয শাহী’র ৩য় খন্ডের ৩য় অধ্যায় ও তারিখ-ই-আলাঈ)। আমার এতগুলো কথাবলার কারণ হচ্ছে- এটা দেখানো যে- সিংহাসনে আরোহণের পূর্বেই তিনি বিস্তর ধন-সম্পদ লাভ করেন। এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শী তারিখ-ই-ফিরুয শাহীর লেখক ‘জিয়া-উদ-দ্বীন বারানী’ বলেন “এরপরে(দেবগিরিরর যাদবদের বিরুদ্ধে অভিযান) প্রায় ৬০ বছর অতীত হয়ে গিয়েছে ও প্রায় প্রতি যুগেই বাদশাহীর রদবদলের ফলে বহু মূল্যবান সম্পদ খরচ হয়ে গেছে, তথাপি আজও অনেক ধন-রত্ন ও অন্যান্য বহু মূল্যবান সামগ্রী আজও দিল্লীর কোষাগারে মওজুদ আছে”(তারিখ-ই-ফিরুয শাহীর ৩য় খন্ডের ৩য় অধ্যায়)। আলা-উদ-দ্বীনের রাজ্যজয় ও সম্পদ সংগ্রহ আরম্ভ হয় তার সিংহাসনে আরোহণেরও পূর্বে এবং মেবাড় বিজয়ের ১৩ বছর পূর্বে ১২৯০ ঈয়াসীতে। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বেই তিনি সিরমুর রাজ্য(১২৯৪), মালব(১২৯২) এবং যাদব রাজ্যের বেরার ও গোন্দ্‌ওয়ানা অধিকার করেন। সিংহাসনে আরোহণের পর পারস্যের ইলখানাতভুক্ত সিন্দ্‌(১২৯৬) ও তুর্কীস্তানের চাগতাই খানাতভুক্ত পাঞ্জাব(১২৯৯) পুর্নদখল করেন। ১২৯৭ ঈসায়ীতে গুজরাট ও ১৩০১ ঈসায়ীতে রণথম্ভোরের চৌহানরাজ্য অধিকৃত হয়। এরফলে ১৩০৩ ঈসায়ীতে মেবাড়ের অবস্থা ছিলো #এমন,
মেবাড়ের ৩ দিকেই খাল্‌জী শাসিত হিন্দুস্তান সালতানাত চেপে আসছিলো। সুলতানের সিংহাসনারোহণকালে মালব স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলো। শুরুতেই বলে নিচ্ছি- মেবাড়ের তৎকালীন ইতিহাস সম্পর্কে খোদ মেবাড়ী সূত্র থেকে কিছুই জানা যায় না। কারণ তাদের অবস্থা ছিলো আদিম প্রকৃতির, তখনও মেবাড়ে ইতিহাস রচনার প্রথাই গড়ে ওঠেনি। মেবাড়ের তৎকালীন ইতিহাস এমন কি খোদ রাজার নামই ১ম মেবাড়ের সূত্রেই জানা যায় ঘটনার(১৩০৩ ঈঃ) ১৫৭ বছর পর ১৪৬০ ঈসায়ীতে মেবাড়ের কুম্ভলগড়ের ১টি রাজপ্রশস্তিতে! আর ১৪৬০ ঈসায়ীতে মেবাড়ের শাসনগোষ্ঠী ছিলো শিশোদীয়া গোত্র, আর আমাদের আলোচ্য সমইয়(১৩০৩ ইঃ) মেবাড়ের শাসক গোষ্ঠী ছিলো গুহিলা গোত্রের। আর এটাই মেবাড়ের ১মাত্র নিজস্ব সূত্র! কিন্তু তাতে কিন্তু কোত্থাও লিখা নেই যে- মেবাড়ের রাজা বীরত্বের সাথে লড়েছিলো বা পদ্মিনী/পদ্মবতী নামে আসলেই কোন রাণী ছিলো!! পদ্মাবতী/পদ্মবতী/পদ্মিনী নামক সেই রাণীর কথা ১ম জানা যায় ঘটনার(১৩০৩ ঈঃ) ৩৭২ বছর পর ১৬৭৫ সালে মালিক মুহাম্মাদ জায়গী নামক এক কবির “পদ্মবৎ” নামক এক কাব্যগ্রন্থে! মজার ব্যাপার হচ্ছে- কুম্ভলগড় প্রশস্থিতে মেবাড়ের রাজার নাম বলা হয়েছে ‘রতন রাওল’ আর পদ্মবতে ‘রতন সেন’, এবারে বুঝুন অবস্থা! যেখানে ঘটনার ৩৭২ বছর পরও রাজা-রাণী একজনেরও নামের ঠিক নেই- সেখানে এটা নিয়ে ১ নট্‌ সিনেমাই বানিয়ে ফেললো- রতন রাওল বা রতন সেন কোন নামই না নিয়ে সে গ্রহণ করলো আধুনিক রাজপুতদের লোকমুখে প্রচলিত নাম ‘রতন সিংহ’ এবং পদ্মবত থেকেই সে তার কাহিনীর রসদ যোগাড় করেছে তাই রাণীর নাম দিলো পদ্মাবতী। আমরা এখন দেখবো আসলেই কি ঘটেছিলো সেই ১৩০৩ ঈসায়ীতে মেবাড় বিজয়ের সময়

মেবাড় আক্রমণের কারণ
আলা-উদ-দ্বীন মুহাম্মাদ শাহ্‌ বিস্তর ধন-সম্পত্তি সিংহাসনে আরোহণের করেন, সেটার পরিমাণ এতোই বেশি যে- প্রত্যক্ষদর্শী লেখক বারানীও বিষ্ময় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি সিংহাসনে আরোহণকালে –এ নামও উঠিয়ে ছিলেন- জনগণের মাঝে মিনজানিক দিয়ে স্বর্ণ ও রৌপ্য নিক্ষেপ করে! এ ব্যাপারে বারানী তার তারিখ-ই-ফিরুয শাহী’র ৪র্থ খন্ডের ১ম অধ্যায়ে বলেন “মিনজানিক চালকের প্রতি নির্দেশ ছিলো ‘রাত্রিবাসের জন্য সুলতানের তাবু যে কোন স্থানেই টানানো হোক না কেন, সে যেনো প্রতিদিন মিনজানিকের সাহায্যে ৫মণ স্বর্ণ-রৌপ্যের তোড়া ভরে উপস্থিত লোকদের মাঝে নিক্ষেপ করে! লোকেরা চর্তুদিকে ভীড় করে এসব কুড়িয়ে নেবে। এরফলে সুলতানের তাবুর চর্তুদিকে মানুষের হাট বসে গেলো। ২/৩ সপ্তাহ যেতে না যেতেই হিন্দুস্তানের সকল পল্লী ও শহরে এই সংবাদ প্রচার হয়ে গেলো যে ‘সুলতান আলা-উদ-দ্বীন দিহ্‌লী(দিল্লী) জয়ের জন্য যাচ্ছেন এবং মানুষের মাঝে বেশুমার ধন-সম্পদ বিলিয়ে দিচ্ছেন। এই সংবাদে চর্তুদিক থেকে সৈন্য ও সাধারণ লোকেরা সুলতানের সেনাবাহিনীর দিকে দৌড়াতে লাগলো। সুলতান আলা-উদ-দ্বীন বাদাউন পৌছাতে না পৌছাতেই ৫৬,০০০ অশ্বারোহী ও ৬০,০০০ পদাতিক(মোট ১,১৬,০০০ সৈন্য!) চর্তুদিকে জড়ো হলো। সাধারণ লোকের ভীড় ছিলো সংখ্যাতীত”। এই বিপুল সম্পদ ও সৈন্য নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন ও দিল্লীর কোষাগারে আরও ধন-সম্পদ পেয়ে তিনি আরও সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। এত সম্পদ তিনি অকাজে ব্যয় না করে তাদ্দ্বারা সেনাবাহিনী গড়ে তুলেন। বারানী ১২৯৯ সালের ঘটনায় বলেন “হাটীশালায় প্রচুর হাতী ও ঘোড়াশালায় ৭০,০০০ এর বেশি ঘোড়া জমা হয়েছিলো”!(৪র্থ খন্ডের ২য় অধ্যায়)। আলা-উদ-দ্বীন খাল্‌জীর মোট ২টি সেনাদল ছিলো(তারিখ-ই-ফিরুয শাহীর ৪র্থ খন্ডের ৫ম খন্ড), আমরা এর ১টি মাত্র সৈন্যসংখ্যা জানি- ফুতুহ্‌-উস-সালাতীন ও গুলজার-ই-ইব্‌রাহীমি থেকে “৪,৭৫,০০০ অশ্বারোহী, ৯ লাখ পদাতিক ও ৭০,০০০ রণহস্তী”! অর্থ ও সৈন্যের হিসাব এজন্যেই দিলাম যাতে ঐ সময়ে সুলতানের অবস্থা সম্পর্কে আঁচ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে তখন হিন্দুস্তান সালতানাত ছিলো কানায় কানায় পানি ভর্তি ১পাত্রের মতো- যা চুইয়ে পড়তে প্রস্তুত। হিন্দুস্তানের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি এতোই তুঙ্গে উঠেছিলো যে- তা সবকিছুকে প্লাবিত করতে চলেছিলো- বিধ্বংসী বন্যার মতো। কিন্তু মেবাড় ১টি অনুর্বর ও পার্বত্য রাজ্য, রাজপুতানার বাকি রাজ্যগুলো যথা- মারওয়ার, জালোর ও রণথম্ভোরের অবস্থাও তাই ছিলো। তাই এ রাজ্যগুলো অধিকারের উদ্দেশ্য ছিলো- সাম্রাজ্যিক, অর্থনৈতিক নয়। আলা-উদ-দ্বীন খাল্‌জী প্রথমে চেয়েছিলেন বিশ্বজয় করতে, কিন্তু তার বিশ্বস্থ্য পরামর্শদাতা মালিক আলা-উল-মূল্‌ক(তারিখ-ই-ফিরুয শাহীর লেখক বারানীর চাচা) সুলতানকে এই কাজ থেকে বিরত করান এই বলে যে- ‘এমন কে বিশ্বস্থ ব্যক্তি আছে? আপনি কার উপরে দিহ্‌লীর ভার দিয়ে যাবেন? আপনি না থাকলেই এই হিন্দুরা বিদ্রোহ করবে, মোঙ্গলরা আবার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। তাই হিন্দুস্তানেই থাকুন, আর হিন্দু রাজ্যগুলো জয় করুন, তাতেই আপনার দিগ্বিজয়ের খাহেশ পূর্ণ হবে’। সুলতান তাই গোটা ভারতকে ইসলামের পদতলে আনার উদ্দেশ্যে বিজয়াভিযান আরম্ভ করেন। এর মাধ্যমেই মূলত হিন্দুস্তান শব্দটি অঞ্চলবাচক শব্দের পরিবর্তে দেশবাচক শব্দে পরিণত হয়। এটা ছিলো মূলক একক রাষ্ট্র হিসেবে হিন্দুস্তানের উন্থানের সময়, যারা হিন্দুস্তানকে নিজেদের দেশ বলে ও আলা-উদ-দ্বীন মুহাম্মাদ শাহ্‌কেও গাল ও অপবাদ দেয়! তাদের বলছি- এটা আপনাদের পিতা ও হিন্দুস্তানের জন্মের সময়কার কাহিনী। আলা-উদ-দ্বীন খাল্‌জী কতোটা দূরদর্শী ও কৌশলী ছিলেন- তা #এই_মানচিত্রটি
দেখলেই বুঝতে পারবেন। তিনি প্রথমেই সীমান্তবর্তি মারওয়ার বা মালব আক্রমণ না করে ১২৯৭ ঈসায়ীতে শুরুতেই নিজ ভাই উলুগ খান ও মন্ত্রী নূসরত খানকে গুজরাট অভিযানে প্রেরণ করেন। কারণ গুজরাট ছিলো অত্যন্ত সম্বৃদ্ধ ও ধনী ১টি রাজ্য, এর সম্বৃদ্ধ বন্দরগুলো যথা- কাম্বে, ভারুচ ও সুরাট ছিলো এর সম্বৃদ্ধির চাবিকাঠি। সুলতান গুজরাট অধিকার করে ১ ঢিলে ৩ পাখী মারলেন-
১/ গুজরাটের সাথে মারওয়ার ও মেওয়ার(মেবাড়) বিচ্ছিন্ন করে দিলেন, এবং
২/ আয়তনের সাথে সাথে দিল্লীর অর্থনীতি আরও মজবুত হলো ও
৩/ দাক্ষিণাত্য অভিযানের সহজপথ মুক্ত হলো।
১২৯৯ ঈসায়ীতে গোটা গুজরাট অধিকৃত হয়, সুলতান এই বছরেই চৌহান রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। এই #রণথম্ভোর_দূর্গ
ছিলো দুর্ভেদ্য এক দূর্গ যা সুলতানের চাচা ভূতপূর্ব সুলতান ফিরুয শাহ্‌ খাল্‌জীও অধিকার করতে পারেননি। তখন মেবাড়ের রাজা ছিলেন সমর সিংহ, তিনি দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন; তিনি এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে- একদিকে গুজরাটের পতন ঘটছে মেবাড়ের দক্ষিণে! অপরদিকে উত্তরে চৌহান রাজ্যে অভিযান প্রেরণ করা হয়েছে, অতএব মেবাড় দৃশ্যত হিন্দুস্তানের খাল্‌জী সালতানাতের ঘেরাওয়ের ভেতর পরে যাচ্ছে! তাই গুজরাট অধিকার করে ফেরের পথে সমর সিংহ নূসরাত খানের কাছে দূত মারফত কর প্রেরণ করে স্বেচ্ছায় সুলতান আলা-উদ-দ্বীন খাল্‌জীর আনুগত্য স্বীকার করেন(ফুতুহ্‌-উস-সালাতীন)। তার উদ্দেশ্য ছিলো আলা-উদ-দ্বীনের শক্তিশালী থাবা থেকে মেবাড়কে রক্ষা করা। সুলতান সমর সিংহের এই আনুগত্য প্রকাশে খুশী হন সমর সিংহকে উপহার প্রদান করে- আশ্বস্থ্য করেন(গুলশান-ই-ইব্‌রাহীমি)।
মেবাড় সম্পর্কে ইতিহাসের উৎস
খোদ রাজপুত ইতিহাসই রাজপুতদের নিয়ে নিরব! রাজপুত সূত্র থেকেই রাজপুত ইতিহাস জানার কোন সুযোগই আমাদের নেই। রাজপুত সূত্র থেকে রাজপুত ইতিহাস জানার মাধ্যম ইতিহাস নয় বরং রাজপ্রশস্থি ও কিছু লৌকিক কাহিনী। সেগুলোর ধরণ আমার এমন যে- ‘এক যে ছিলো রাজা, আর এক রাণী, তাদের ছিলো খুব ফুটফুটে এক রাজকুমারী’ এগুলো মানুষের মনে কেবল অবিশ্বাস ও হাসির খোরাকই যোগাতে পারে- জ্ঞানের খোরাক নয়। ১ম রাজপুত সূত্রে মেবাড়ের রাজার নাম জানা যায় ঘটনার ১৫৭ বছর পরে! তাও কোন রাজপুত ইতিহাসেও নয়, বরং কুম্ভলগড়ের ১টি রাজপ্রশস্থি। রাজপ্রশস্থি ব্যাপারটা কোন ধরণের ছিলো তা বোঝানোর জন্য ১টা উদাহারণ দিচ্ছি, ঢাকার যে কোন মহাসড়কে দেখবেন- শেখ মরহুম সাহেব ও মাননীয়া শেখা হাসিনাকে নিয়ে নানান পদ- দেয়ালে, ব্যানারে, পোষ্টারে লিখা। যার অধিকাংশই মহা অতিরঞ্জিত। ঠিক রাজপ্রশস্থিও অমন-ই ছিলো, যেখানে রাজকবিরা তাদের রাজাদের গুণকীর্তন করতো। ১৪৬০ ঈসায়ীতে রচিত কুম্ভলগড়ের রাজপ্রশস্থিতে মেবাড়ের রাজাদের গুণকীর্তন করা হয়েছে, তাতে রতন রাওল নামক এক রাজার নাম করা হয়েছে- যিনি সাহসী ছিলেন আর সুলতান আলা-উদ-দ্বীনের আনুগত্য অস্বীকার করেছিলেন, ফলসরুপ ম্লেচ্ছ(বিদেশী) তুরষ্ক(তুর্কী)দের হাতে রাজ্য হারিয়েছিলেন। রতন রাওলকে আমরা ‘রতন সিংহ’ নামে অভিহিত করছি, কারণ- কাক্কাসূরি/কোক্কা সুরি নামক জনৈক জৈন সন্ন্যাসী যিনি মেবাড় যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন- তিনি ঘটনার ৩৩ বছর পর সংস্কৃততে ১টি বই লিখেছিলেন “নভি নন্দনা জীবণধারা প্রবন্ধ” নামে, তাতে তিনি তার নিজের চোখে দেখা ঘটনাগুলো এবং জানে শোনা ঘটনাবলি নিয়ে ৯টি খন্ডে সুলতান আলা-উদ-দ্বীন মুহাম্মাদ শাহ্‌’র জীবণি রচনা করেন, আর তাতে রাজার নাম দিয়েছেন রতন সিংহ। আরও ২টি সমসাময়িক সূত্র আমরা পাই- প্রথমটি সুলতানের চাচার নাদীম(সভাসদ) ও সুলতানের আমলের নাদীম ও কাজ্বী জিয়া-উদ-দ্বীন বারানী কর্তৃক রচিত তারিখ-ই-ফিরুয শাহীর বিশাল ১টি আস্ত খন্ডে ও তারিখ-ই-আলাঈতে। এবং দ্বিতীয়টি পাই সুলতানের সভাকবি বুল্‌বুল-ই-হিন্দ্‌ আমীর খুসরু’র ‘খাজাঈনুল ফুতুহ্‌’ ও ‘দুওয়াল রাণী-খিজির খান’-এ। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে- কাক্কাসূরি, বারানী ও আমীর খুসরু এই ৩জনের কারও ইতিহাসেই কিন্তু পদ্মাবতী/পদ্মিনী বা পদ্মবতি নামে কোন রাণী দূরে থাক- চিত্তোরের রাণী, জওহরব্রত ও রতন সিংহের বীরত্বের কোন উল্লেখমাত্রও নেই! রাণী পদ্মিনী, জওহরব্রত, রতন সিংহের বীরত্ব এগুলোর কিছুরই কোত্থাও উল্লেখে নেই! রাজপুত সূত্রেও না! কারণ এই পুরোটাই ১ মূর্খ বদমায়েশ কবির ভুল, মালিক মুহাম্মাদ জায়সী নামক এই কল্পনাবিলাসী ব্যক্তি ১৫৪০ ঈসায়ীতে পদ্মাবত নামক ১টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তাও এমনই এক কাব্যগ্রন্থ সেটা- যার প্রাচীনতম পুথি কিন্তু এত্ত পুরাতন নয়! ১৫৪০ সালে এটা লিখা হয়েছে বলা হলেও পদ্মাবতের প্রাচীনতম পান্ডুলিপির তারিখ কিন্তু ১৬৭৫ ঈসায়ীতে!! তাও এটা কিন্তু মালিক মুহাম্মাদ জায়সীর নিজের হাতের লিখা নয়- বরং মুহাম্মাদ শাকের নামক এক ব্যক্তির লিখা। আর তিনিই বলেছেন জায়সী এটা ১৫৪০ সালে রচনা করেন, কিন্তু কোথায় সেই ১৫৪০ সালে রচিত পান্ডুলিপি? সে ব্যাপারে কিন্তু এরা সবাই নিরব। এটা খুবই হাস্যকর ও লজ্জাজনক ব্যাপার যে- যার ভিত্তিই ঠিক নেই- তাক নিয়েই এত নাচানাচি। প্রকৃত ঘটনা বোঝানোর জন্যেই আমাদের আবার রণথম্ভোরে যেতে হবে, কারণ- না হলে এটা বোঝানো যাবে না যে- কিভাবে জায়সী এসব কথা বললেন! #রণথম্ভোর
ছিলো ১টি দুর্ভেদ্য দূর্গ, এতে চৌহানরাজ ২য় পৃথ্বী’র বংশধরেরা টানা রাজত্ব করে আসছিলেন। ১২৯৯ ঈসায়ীতে এর রাজা ছিলেন –হামির দেব চৌহান। ১২৯০ সালে সুলতানের চাচা ও ভূতপূর্ব সুলতান জালাল-উদ-দ্বীন ফিরুয শাহ্‌ খাল্‌জী দু-দু’বার রণথম্ভোর জয়ের চেষ্ঠা করে ব্যর্থ হন! সুলতান আলা-উদ-দ্বীন খাল্‌জী ১২৯৯ সালে রণথম্ভোর অধিকারের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী নূসরাত খানকে প্রেরণ করেন। কিন্তু ১ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দূর্গের পতন হলো না! উপরন্ত দূর্গের উপর থেকে রাজপুতদের নিক্ষিপ্ত পাথরের কারণে নূসরাত খান মারা গেলে সুলতান খুবই ক্রুদ্ধ হন ও নিজেই রণথম্ভোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু পথিমধ্যে সুলতানের ভাতিজা আতাক খান কিছু মোঙ্গল নওমুসলিম সৈন্যের সাহায্যে সুলতানকে হত্যার চেষ্ঠা করে ব্যর্থ হন! আতাক খানের বিদ্রোহ ও দোষীদের শাস্তি দেয়াহয় ঠিকই, কিন্তু সুলতান খুবই ক্রুদ্ধ হন মোঙ্গলদের নিমকহারামী দেখে। বহু মোঙ্গল ইসলাম গ্রহণ করায় সুলতান তাদের বিভিন্ন চাকরীতে নিযুক্ত করে জায়গীর দিয়েছিলেন। কিন্তু সুলতানের উপর প্রথম তীর নিক্ষেপ করেছিলোই ঐসব নও-মুসলিম মোঙ্গলরা। তাই আতাক খান নিহত হওয়ার পর মোঙ্গলরা যেহেতু সুলতানকে খুব ভালো ভাবেই চিনতো- সেহেতু তারা স্বদলবলে রণথম্ভোর দূর্গে আশ্রয় নেয়। আতাক খানের বিদ্রোহ দমনের পর সুলতান স্বয়ং রণথম্ভোরের সামনে শিবির স্থাপন করেন(তারিখ-ই-ফিরুয শাহীর ৪র্থ খন্ডের ৩য় অধ্যায়)।
রণথম্ভোরের পতন ও মেবাড় আক্রমণ
নুসরাত খানের মৃত্যুর পর সুলতানের ভাই ও সেনাপতি উলুগ খান সুলতানী বাহিনীর সৈন্যাপত্য গ্রহণ করেন। কিন্তু নূসরাত খানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ক্রুদ্ধ সুলতান আলা-উদ-দ্বীন স্বয়ং ১ লাখ সৈন্যসহ রণথম্ভোর হাজির হন। সুলতান এসে দূর্গের চর্তুদিকে কড়া পাহার বসিয়ে এর ভেতরে খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবরোধের অস্ত্র বসান। এতে রাজা হামির দেব চৌহান দূর্গের পতন আসন্ন বুঝতে পেরে সসৈন্যে দূর্গ থেকে বেড়িয়ে আসেন। তবে তার আগে নও-মুসলিম মোঙ্গলদের স্বঘোষিত সুলতান মুহাম্মাদ শাহ্‌ নিজের স্ত্রী-কন্যাদের নিজের হাতে হত্যা করে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত হামির দেবের পক্ষে লড়ার প্রতিজ্ঞা করেন। যুদ্ধে নও-মুসলিম মোঙ্গলদের মদদপুষ্ট হামির দেবের চৌহান বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এই সংবাদ শোনামাত্রই #হামির_দেবের_প্রাসাদে
রাজপুত রমণীরা #জওহর_ব্রত
পালন করেন। দূর্গবাসীদের ব্যাপারে সুলতান কঠোর নির্দেশ দিলেন- “সমস্থ দূর্গবাসীকে হত্যা কর”, সুলতানের এই কঠোর আদেশের ফলে ২০,০০০ মোঙ্গল নও-মুসলিম বিদ্রোহীসহ ৩০,০০০ মানুষ নিহত হয়। ১৩০১ ঈসায়ীর ১০-ই জুলাই রণথম্ভোর দূর্গসহ গোটা চৌহানরাজ্য সুলতানের পদানত নয়, এরফলে ঐতিহ্যবাহী চৌহান রাজবংশের নাম ধরাপৃষ্ঠ থেকে মুছে যায়, উলুগ খানকে এই গোটা এলাকার শাসনভার দেয়া হয়(খাজাইনুল ফুতুহ্‌, তারিখ-ই-ফিরুয শাহী ও গুলশান-ই-ইব্‌রাহীমি)। দ্রষ্টব্যের ব্যাপার হচ্ছে- সুলতান কিন্তু তখনও মেবাড়ের দিকে হাত বাড়াননি! কারণ মেবাড়ের রাজা সমর রাওল/সমর সিংহ আলা-উদ-দ্বীন খাল্‌জীর অনুগত ছিলেন। কিন্তু সুলতান এসময় মদ্যপান নিষিদ্ধ, দ্রব্য মূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পরায় মেবাড় আপাতত রক্ষা পায়। কিন্তু ১৩০২ ঈসায়ীতে মেবাড়ের রাজা সমর সিংহের মৃত্যুর পর রতন সিংহ সিংহাসনে আরোহণ করেই সুলতানকে কর প্রেরণ বন্ধ করে দেন। ১৩০১ সালের কর ১৩০২ সালে পাওয়ার কথা, কিন্তু রতন সিংহ সেটা দেননি। এ ব্যাপারে রতন সিংহকে ভয় দেখিয়ে কর আদায় করার জন্য সুলতান উলুগ খানকে সসৈন্যে চিত্রকূট(চিত্তোর) যেতে আদেশ দেন। উলুগ খান সসৈন্যে চিত্রকূট হাজির হন ও বকেয়া কর দাবী করেন, কিন্তু রতন সিংহ উলুগ খানের কথায় কর্ণপাত করেননি। দুর্গম পাহাড়, খরস্রোতা নদী ও উষর ভূমি বেষ্টিত সুরক্ষিত রাজ্যের অধিপতি হওয়ায় রতন সিংহ এত সাহস পেয়েছিলেন(কাক্কাসূরি)। সবকিছুর মূলে ছিলো তার রাজধানী চিত্রকূটে অবস্থিত #চিত্রকূট_দূর্গ,
যা বর্তমানে চিতোর(চিত্তোর) নামে খ্যাত। ১৮০ মিটার উচু খাঁড়া পাহাড়ের উপর অবস্থিত চিত্রকূট ছিলো সেই আমলের ১টি দুর্গম দূর্গ, একে অজেয় হিসেবেই ভাবা হতো। যাহোক রতন সিংহ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে উলুগ খান দূর্গ অবরোধ শুরু করলেন, কিন্তু কিছুদিনের মাথায় সিরি(রাজধানী) থেকে উলুগ খানের ডাক এলো। চাগতাই খান ‘দুয়া খান’ তার দুর্ধর্ষ সেনাপতি তুরগী খানকে হিন্দুস্তান অধিকারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন। আর এটা এমন এক সময় যখন মুসলিম বাহিনী বিভিন্ন দিকে অভিযানে গিয়েছে! উলুগ খান মেওয়ার(মেবাড়) এসেছেন আর জুনা খান, হযরত ও মালিক জাহ্‌য তেলিঙ্গানার কাকতীয় রাজ্য অভিযানে গিয়েছিলেন। ফলে সুলতান সবচেয়ে কাছে থাকা উলুগ খানকেই সসৈন্যে ডেকে পাঠান। উলুগ খান সসৈন্যে রওয়ানা হন, কিন্তু পথিমধ্যে তিনি ইন্তেকাল করেন। যাইহোক উলুগ খানের বাহিনী ফিরে আসায় সুলতান মালিক আ’আয্‌-উদ-দ্বীন বুরখানকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে তুরগীকে প্রতিরোধের দায়িত্ব দিয়ে নিজেই রতন সিংহকে শায়েস্তা করার জন্য বেড়িয়ে পরেন। তুরগী খান তার মূল বাহিনীকে পেছনে রেখে আসেন- যাতে আপাতঃ দৃষ্টিতে তাকে দুর্বল মনেহয়। সুলতানের সিরি ত্যাগের পরেই সে তার পুরো বাহিনীকে দৃশ্যপটে হাজির করে- এবারে মোঙ্গল বাহিনীর সংখ্যা ছিলো কোন রকম সাহায্যকারী বাহিনী ছাড়াই ১,২০,০০০। ১৩০৩ ঈসায়ীতে সুলতান যখন মেবাড়ের রাজধানী চিত্রকূটে পৌছান তখন তিনি তুরগী খানের এই বিপুল বাহিনী এসে পরার সংবাদ শুনতে পান। কিন্তু দৃঢ়চেতা সুলতান তবু চিত্রকূট ছেড়ে তুরগী খানের পিছু ধাওয়া করলেন না! বরং তিনি আ’আয্‌কে কড়া নির্দেশ দিলেন- কঠিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। যাতে মোঙ্গলদের কাছে ১জন মানুষও প্রাণ না হারায়। আ’আয্‌ মুসিবতে পরে গেলেন, তবু দৃঢ় প্রতিরোধ ব্যবস্থাই গড়ে তুললেন। সুলতান উপস্থিত না থাকায় সবাই মোঙ্গলদের মাঝে এতোই ভীত হয়ে উঠলো যে- মোঙ্গলরা সুলতানের অনুপস্থিতে আর মাত্র ১টা মাসও যদি সেখানেই অবস্থান করতো- তবে সবাই মোঙ্গলদের ভয়েই পালিয়ে যেতো(কাক্কাসূরি, তারিখ-ই-ফিরুয শাহী, ফুতুহ্‌-উস-সালাতীন ও খাজাইনুল ফুতুহ্‌)। সুলতান রতন সিংহের কাছে দূত পাঠিয়ে তার আনুগত্য স্বীকারের জন্য শেষবারের মতো আহবান করেন। নতুবা ধ্বংস ও লজ্জাজনক পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। কিন্তু রাজা এবারও সুলতানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন(খাজাইনুল ফুতুহ্‌)।
রতন সিংহের পরিণতি
রতন সিংহ সুলতানের আনুগত্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে সুলতান আলা-উদ-দ্বীন মুহাম্মাদ শাহ্‌ চিত্রকূট অবরোধ আরম্ভ করেন। প্রথম দিকে সুলতান #বেরাচ_নদীর
তীরে শিবির স্থাপন করেছিলেন। বেরাচ নদীর তীর ধরেই মুসলিম বাহিনী তাবু ফেলেছিলো। ১৩০৩ ঈসায়ীর ২৮শে জানুয়ারী সুলতান চিত্রকূটে এসে পৌছেছিলেন, এবং বেরুচ নদীর তীর ধরে তার সৈন্যরা অবস্থান নিয়েছিলো। রতন সিংহ সুলতানের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করার পর- সুলতান দূর্গে আক্রমণের নির্দেশ দেন। সৈন্যরা দূর্গের দুর্বল স্থানের খোঁজে বেড়িয়ে পরে ও দুর্বল দিকগুলোতে ভারী ভারী পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। সুলতানের নির্দেশ ছিলো-‘এর প্রতিটি পাথর খুলে হলেও এই দূর্গের পতন ঘটাতেই হবে’। Trebuchet(প্রস্থর নিক্ষেপকারী দূরপাল্লার অস্ত্র) দিয়ে ভারী ভারী পাথর নিক্ষেপে রাজপুতদের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়- কিন্তু দূর্গের পাষাণ দেয়ালে ফাঁটল ধরানো যায়নি। এভাবেই বর্ষাকাল চলে আসে ও ২ মাস তা প্রলম্বিত হয়। টানা বৃষ্টিও সুলতান আক্রমণ বন্ধ করেননি- তিনি তার শিবিরের সম্মুখ থেকে বৃষ্টির ভেতরেই সৈন্যদের তীব্র আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন। বৃষ্টি মাথায় করে সৈন্যরা অগ্রসর হয় ও দূর্গের পাদদেশ পর্যন্ত পৌছে গেলেও এই আক্রমণ ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ব্যর্থ হয়। বৃষ্টির সেই ২টি মাসে সুলতানের নির্দেশে দু দু’বার আক্রমণ চালানো হয়, কিন্তু ২ বারই ভারী বর্ষণের কারণে আক্রমণ ব্যর্থ হয়। বর্ষাকাল শেষে সুলতান সৈন্যদের কিছুদিন বিশ্রাম দেন ও ৩য় বার চিত্রকুট অধিকারের ১ সর্বগ্রাসী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন- সেটি হচ্ছে –‘চর্তুদিক থেকে এই দূর্গ ঘিড়ে ফেলা ও সব দিক থেকে এর উপর এক যোগে আক্রমণ করা’। আমীর খুসরু ও ইসামীর ভাষ্যে এতটুকু বোঝা যায় যে- সুলতানী বাহিনী সংখ্যায় এক লাখেরও উর্ধ্বে ছিলো!! সুলতানের এই ৩য় পদক্ষেপে কাজ হয়- চর্তুদিক থেকে ২.৮ বর্গ কি.মি. আয়তনের দূর্গকে ঘিরে ফেলা হয় ও এক যোগে সবদিক থেকেই দূর্গের উপর ভারী পাথর, অগ্নিগোলক ও তীর নিক্ষেপ করা হয়। এতে রাজা রতন সিংহ ভীত হয়ে পরেন ও আত্ন-সমর্পণ করেন। ২৬শে আগষ্ট ১৩০৩ ঈসায়ীতে সুলতানের চিত্রকুট আগমণের ৬ মাস ২৮ দিন পর চিত্রকূট(চিত্তোর) দূর্গের পতন ঘটে। মুসলিম বাহিনী বাঁধ ভাঙা জোয়ারের পানির মতো শহরে প্রবেশ করে ও সুলতানের নির্দেশে সমস্থ সৈন্যদের হত্যা করে। ৩০,০০০ হিন্দু সৈন্যেকে ঘাঁসের মতো কেটে ফেলা হয়(আমীর খুসরুর ‘খাজাইনুল ফুতুহ্‌’ ও ইসামীর ‘ফুতুহ-উস-সালাতীন’)। রতন সিংহের কি হয়? তা মুসলিম নয়, ১টি অমুসলিম সূত্র থেকেই শুনি? “রতন সিংহ গলায় শিকল ঝুলিয়ে সুলতান আলাভাদিন(আলা-উদ-দ্বীন) এর কাছে আত্ন-সমর্পণ করেন ও তার আনুগত্য স্বীকার করে নেন। কিন্তু সুলতান বলেন ‘আমাকে এ পর্যন্ত টেনে আনার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে’। তিনি রাজাকে খাঁচায় ভরার নির্দেশ দেন, রাজাকে খাঁচায় ভরা অবস্থায় সুলতান চিত্রকুট দূর্গে প্রবেশ করেন ও জীবিত রাজপুতদের সামনে তাকে বানরের অভিনয় করতে বাধ্য করা হয়। রতন সিংহকে মেবাড়ের প্রতিটি শহরে খাঁচায় আবদ্ধ অবস্থায় সুলতানের সাথে ভ্রমণে বাধ্য করা হয়। নিজের সাবেক প্রজাদের সামনেই বানরের আচরণ করিয়ে তাকে হীন করা হয়, রাজার মর্যাদা ভূ-লুন্ঠিত হয়! তবে আলাভাদিন যদিও খুব গম্ভীর মানুষ ছিলেন, তবু রাজার বানরের অভিনয়ে খুশী হলে হেসে ফেলতেন ও সেইদিন নিজের সাথে নিয়ে খেতে বসতেন”(নভি নন্দনা জীবণধারা প্রবন্ধ, ৪র্থ অধ্যায়- কাক্কা সূরি)। সুলতান চিত্রকূটের নামকরণ করেন নিজ জেষ্ঠ্যপুত্র খিজির খানের নামানুসারে ‘খিজিরাবাদ’ এবং মালিক আবু মুহাম্মাদকে মেবাড়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে সুলতান চিত্রকুট ত্যাগ করেন(তারিখ-ই-ফিরুয শাহী’র ৪র্থ খন্ডের ৫ম অধ্যায়)।
শেষ কথা
ঈসায়ী ১৩০৩ সালের ২৬শে আগষ্ট দুর্ভেদ্য নামে খ্যাত চিত্রকুটের পতন ঘটলো, আল্লাহ্‌ সুলতান আলা-উদ-দ্বীন খাল্‌জীকে একই সাথে দু’টি বিজয় দান করলেন। তুরগী খান ১,২০,০০০ সৈন্যসহ সিরি অধিকারের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ ২ মাস সুব্‌হানী মুঈযী ও হাল্‌দী চাবুতারাহ্‌(চত্ত্বর) এবং সুলতানী চৌবাচ্চায় অবস্থান করছিলো। সুলতান না থাকায় প্রজা-সাধারণ এতোই ভয় পেয়েছিলো যে- এ ব্যাপারে বারানী বলেন “তুরগী খান যদি আরও ১মাস যমুনার ঘাটগুলো বন্ধ করে বসে থাকতেন- তাহলে লোকজন যেমন ভয় পেয়েছিলো- তাতে অতি সহযেই কিছু সংখ্যক সৈন্য দ্বারাই দিল্লী জয় করতে পারতো”(তারিখ-ই-ফিরুয শাহী)। কিন্তু হঠাৎ করেই ১৩০৩ ঈসায়ীতে তুরগী অবরোধ উঠিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, বারানীর বলে শাইখ নিজাম-উদ-দ্বীন আউলিয়ার দু’আর বদৌলতে তুরগী অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে যান। এরফলে সুলতান দূর-দুরান্তে রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্যে নিজে যাওয়া বন্ধ করেন- ও মোঙ্গল আক্রমণের পথে- সীমান্তে পুরাতন দূর্গগুলো সংস্কার ও নতুন নতুন দূর্গ নির্মাণ করে সীমান্ত সুরক্ষিত করেন। তুরগীর আক্রমণের পর সুলতান আর কখনই নিজে কোন রাজ্যবিজয়ে যাননি। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এরপরও সুলতানকে রাজপুতদের তুলনায় হীনবল প্রমাণ করার জন্য বলেন ‘উনি(আলা-উদ-দ্বীন) চিতোরের নামকর ণ করেন খিজিরাবাদ এবং শাহ্‌যাদা খিজির খানকে মেবাড়ের শাসনভার প্রদান করে যান, কিন্তু রাজপুতদের প্রবল বিরোধীতার মুখে খিজির খান মেবাড় ত্যাগ করলে- মারওয়ারের রাজা মালদেবকে মেবাড়ের শাসক নিযুক্ত করা হয়’। এই মতের উদ্ভাবক বানারসী প্রসাদ সাকসেনা, এটা আর যাইহোক সত্য হতে পারে না। কারণ খিজির খান তখন(১৩০৩ ঈঃ) নাবালেগ ছিলেন। তার প্রমাণ বারানী তারিখ-ই-ফিরুয শাহীর ৪র্থ খন্ডের ৭ম অধ্যায়ে আলাঈ শাসনামলের শেষ অবস্থা বর্ণনা করার সময় বলেন “সুলতান নিজের পুত্রদেরকে তাদের বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতা দেখা দেয়ার আগেই সংরক্ষিত অবস্থা(হারেম) থেকে বাহিরে বেড় করে আনলেন। খিজির খানকে বাদশাহী ছত্র দান করলেন এবং তার প্রাসাদ ও দরবারী ব্যবস্থায় আতিশয্য প্রদর্শন করলেন”। তার মানে দাঁড়ায় ১/খিজির খান তখনও পূর্ণ বয়স্ক হননি এবং ২/তিনি তখনও হারেমেই থাকতেন- কোন প্রশাসনিক দায়িত্ব ইতিপূর্বে তার উপর অর্পিত হয়নি। অনেকে হয়তো বলতে পারেন নাবালেগ অবস্থাতেই উনার উপর মেবাড়ের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। কিন্তু সেটাও হয়নি, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তারিখ-ই-ফিরুয শাহীর ৪র্থ খন্ডের ৫ম অধ্যায়ে। যেখানে বারানী স্পষ্টভাবে বলেন “গুজারাতে আলী খান, মূলতান ও সিওয়াস্তানে তাজুল মূল্‌ক কাফুরী, দেবপালপুরে গাযী মালিক তুগলাক্ব, সামানাহ্‌ ও সান্নামে মালিক আখুর বেগ তাতাক, মাল্‌ওয়াতে আইনুল মূল্‌ক মুলতানী, ঝাবনে ফাখ্‌রুল মূল্‌ক মায়সাতারী, ‘চিতোরে মালিক আবু মুহাম্মাদ’............... এবং কোরায় মালিক নাছির-উদ-দ্বীন সুতীলার শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে”। ১৩০৮ ঈসায়ীর ঘটনা বলার সময় বারানী এটি বলেন, কিন্তু সাকসেনার কথামতো তো চিতোরের শাসনভার তখন মালদেবের হাতে থাকার কথা! আশাকরি আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে- আমি গতানুগতিক মেবার না বলে মেবাড় বলছি, কারণ আমি বাংলাভাষী। আর বাংলায় সবকিছুই লিখা যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে রাজ্যটির আসল নাম मेवाड़, এটা যাদের দেশ সেই রাজপুতরা তাদের দেশকে মেবার নয় বরং মেবাড় লিখে। আর ফার্সীতে এই মেবাড়কেই মেওয়ার বলা হয়, কারণ ফার্সীতে মেবাড় লিখা হয়- এভাবে مورا/ মেওয়ারা/মেওয়ার। একই কারণে চিতোরকে চিত্তোর লিখেছি। যাইহোক মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা ও মিথ্যা প্রচার করা রাজপুতদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। সমসাময়িক ইতিহাসে পদ্মাবতী/পদ্মীনি নামক কোন রাণীর উল্লেখ না থাকলেও বর্তমানে চিত্তোরগড়ে #এই_মূর্তিটির
পূজা করা হয়! দাবী করা হয়- এটি নাকি পদ্মিনীর মূর্তি। রাজপুতদের মিথ্যাচার এটাই ১মাত্র নয়- তারা যোধা-আকবার ছায়াছবিটি মুক্তির পর- বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেছিলো। কারণ তাদের মতে যোধাবাঈ আকবারের নয় জাহাঙ্গীরের স্ত্রী ছিলো! সম্প্রতী রাজস্থান রাজ্য সরকার ইতিহাসও বদলে দিয়েছে! তারা হলদিঘাটের যুদ্ধে বিজয়ী হিসেবে অদ্ভুতভাবে আকবার নয় বরং রাণা প্রতাপ সিংহকে সর্বত্র দেখাচ্ছে!! দিল্লীতে আকবারের সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী রাজধানীতে তার(আকবার) নামের রাস্তার নাম দবলে অযাচিত ভাবে রাণা প্রতাপের নামে তা নামাঙ্কিত করা হয়েছে! সবশেষে বোলব- আলা-উদ-দ্বীন মুহাম্মাদ শাহ্‌ খাল্‌জীকে এসব নটের দল- ছায়াছবি নির্মাণ করে হীন প্রমাণ করতে পারবে না। তিনি ছিলেন ভারতের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম শাসক ও সর্বাধিক রাজ্য বিজেতা। তার বিজয় যেনো তারই #তরবারীতে
খোদিত সেই বিখ্যাত উক্তি نَصْرٌ مِّن اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ সাক্ষ্য। আসলেই তার প্রতি আল্লাহ্‌’র সাহায্য ও বিজয় ছিলো অতি নিকটবর্তী।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক

যৌন সাধনা! Sex Warship !মধুসুন্দরী সাধনা! পারী(পরী) সাধনা! পঞ্চকন্যা সাধনা! ছিন্নমস্তা সাধনা! এবং আমাদের আজকের মূল আলোচ্য 'কর্ণ পিশাচীনি' সাধনার মূলে আসলে কি আছে? দেখুন এই সাধনার পেছনে আসলে কি আছে? কর্ণ পিশাচিনী সাধনা করার বিস্তারিত নিয়ম এই ১ম ইউটিউবে দেখতে পাবেন বিস্তারিত- যেখানে কিছুই বাদ রাখা হয়নি! বিঃদ্রঃ ভিডিওটি সম্পূর্ণভাবেই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও নারীরা দূরে থাকুন।