বীরশ্রেষ্ঠ!
কি নানা কি
দাদাবাড়ী যাওয়ার পথে বাধ্যতামূল ভাবেই কামারখালীর উপর দিয়ে
গড়াই সেতু
পেরিয়েই যেতে হয়। প্রত্যেকবার গড়াই সেতু আসার আগেই কামারখালী থেকেই
ডানপাশে তাকিয়ে থাকি- ১টি বাড়ীর আশায়। যার দেয়ালে বড় বড় করে লিখা আছে “বীরশ্রেষ্ঠ
মুন্শী আবদূর রঊফের বাড়ী”। কি যেতে কি আসতে, আমার ভুল হয় না; নিজের অজান্তেই চোখ
ওদিকেই চলে যায়। মুন্শী আবদূর রঊফ- বাংলাদেশের ৭ শ্রেষ্ঠ বীরের ১জন, যারা
সাহসীকতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
মুন্শী আবদূর রঊফের পিতা মুন্শী মাহ্দী হাসান ছিলেন স্থানীয় মাসজিদের
পেশ-ইমাম। পিতা ও মাতা উভয়ের দিক দিয়েই তিনি ছিলেন মুন্শী বংশের সন্তান। ফার্সী
শিক্ষিত পন্ডিত ব্যক্তিকে মুন্শী বলা হতো, তার পিতা ও দাদা ছিলেন দরিদ্র আলেম।
কিন্তু তার মা মুকীদুন্নেসা ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। ১৯৪৩ সালের মে দিবসে মুন্শী
দম্পতির ২য় সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার নাম রাখা হয় মুন্শী আবদূর রঊফ, ডাকনাম ‘মিত্তাল’-
যেটি গণমাধ্যমের কেউই জানেন না। উনার বড় বোনের নাম জোহ্রা বেগম ও ছোট বোনের নাম
হাজেরা বেগম। জন্মস্থানঃ সালামতপুর গ্রাম, বোয়ালমারী থানা, জেলা-ফারীদপুর। বর্তমানে
গ্রামের নাম রঊফনগর, থানা- মধুখালী। ১৯৫৫ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে মুন্শী মাহ্দী
হাসান ইন্তেকাল করেন। মিত্তালের বয়স তখন মাত্র ১২, তিনি তখন মাত্র ৮ম শ্রেণীর
ছাত্র, ১মাত্র ছেলে হওয়ায় ১২ বছর বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে হওয়ায় লেখাপড়া ছেড়ে দিতে
বাধ্য হন মিত্তাল। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী ও ডানপিটে হিসেবে খ্যাত, অনেক
লম্বা ও তেমনই ফর্সা ছিলেন তিনি।
১৯৬৩ সালের ৮-ই মে ২০ বছর বয়সে তিনি ইষ্ট
পাকিস্তান রাইফেল্স(ইপিয়আর)-
এ যোগদান করেন, চাকুরী পাওয়ার উদ্দেশ্যে এসময় উনার
বয়স দেখানো হয়েছিলো ২৩ বছর। চুয়াডাঙাস্থ ইপিআর কেন্দ্রে (বর্তমান ৬ষ্ঠ বিজিবি
ব্যাটালিয়ন সদর)
প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে তিনি উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের নিমিত্তে পঃ
পাকিস্তানের লাহোরে গমন করেন। ৬ মাসের উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে পূর্ব
পাকিস্তান ফিরে এলে উনাকে সরাইল সেক্টরের অধীনে কুমিল্লায় নিয়োগ দেয়া হয়। স্বাধীনতা
যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি ১১নং উইং-এ কর্মরত ছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি মেজর
জিয়া-উর-রহ্মানের
নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে গড়ে তোলা জেড ফোর্সের
৮ম ইষ্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্টে যোগদান করেন, এসময় তিনি ল্যান্স নায়েক পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময় তিনি মাঝারী এমজি(মেশিনগান) ডিপার্টমেন্টের ১নং এমজি চালক হিসেবে
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথ প্রহরার অন্যতম দায়িত্বে নিয়োজিত
ছিলেন। এসময় তার বিগ্রেড(জেড ফোর্স) কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়া-উর-রহ্মান, এবং ৮ম
ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ছিলেন মেজর এ জেড এম আমীনুল হক্ব।
তার কোম্পানীর দায়িত্ব ছিলো বুড়িঘাট এলাকার চিংড়ি খালের দু’পাড়ে অবস্থান নিয়ে
রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথটি পাক-বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত রাখা।
৮ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল, পাক বাহিনীর পাঞ্জাব
রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানী ও ২য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের ১টি কোম্পানী মর্টার, এমজি, ও
রাইফেল নিয়ে ৭টি স্পীডবোট ও ২টি লঞ্চে করে এগিয়ে আসতে থাকে। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার
হচ্ছে- ১টি মাত্র পদাতিক কোম্পানীর মোকাবিলা তারা ১টি পদাতিক কোম্পানী দিয়ে করাও
যথেষ্ঠ মনে করেনি! বিঁধায় মোট ৩টি কোম্পানী তাঁদের ১টি কোম্পানীর বিপক্ষে নামাতে
হয়, তাও আবার এতে ছিলো ১টি কমান্ডো কোম্পানী!! যুদ্ধের শুরুতেই পাক বাহিনীর আক্রমণ
প্রতিরোধে মুক্তিবাহিনী বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়ে প্রতিরোধ করতে থাকে, কিন্তু ৩” মর্টার
শেল নিক্ষেপ ও ভারী মেশিনগানের গোলাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার ছিন্নভিন্ন হয়ে
যায়। এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পিছুহটা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। সেকশন টুআইসি
(সেকেন্ড ইন কমান্ড) হিসেবে আঃ রঊফ তার নিজের সেকশনসহ গোটা মুক্তিবাহিনীর
নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন ও পিছু হটতে অস্বীকার করেন। সহযোদ্ধাদের
বারংবার পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও আঃ রঊফ বলেন “আমি কখনই পিছু হটবো না, তোমরা যাও। আমি
দেখছি”। তিনি নিজে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাঙ্কারের একাংশে- যা তখনও অটুট ছিলো- তাতে
বসে ছিলেন। তিনি তার ১৫০ জনের বাহিনীকে পিছু হটতে বলে- নিজেই তাঁদের নিরাপত্তার
দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন নিজেকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে। মুক্তিবাহিনী
পিছু হটা আরম্ভ করলে পাক বাহিনীও তাঁদের ৯টি নৌযানে করে এগিয়ে আসতে থাকে। ল্যাঃ
নায়েক মুনশী আঃ রঊফ তার মাঝারী এমজি থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে- একে একে পাক
বাহিনীর ৭টি স্পীড বোট-ই ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন! একে পাক বাহিনী আতঙ্কগ্রন্থ হয়ে আঃ
রঊফের গুলির নাগালের বাহিরে তাঁদের ২টি মাত্র অবশিষ্ট লঞ্চে করে আশ্রয় নেয়। এদিকে
আঃ রউফের টানা গুলিবর্ষণ ধীরে ধীরে গুলির অভাবে কমে আসলে- পাক বাহিনী এবারে
নিশ্চিত হয় যে- গুলি ফুড়িয়ে আসছে! তাই
তারাও তাঁদের ৩” মর্টার দ্বারা একের পর এক শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ১টি শেল আঃ
রঊফের বাঙ্কারে এসে বিষ্ফোরিত হলে আঃ রঊফ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার ফুফাতো ভাই
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জনৈক ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের কাছ থেকে শুনেছি- উচ্চ শিক্ষার
জন্য পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ১টি উচ্চতর সামরিক কোর্সের ক্লাসে তিনি এই অধ্যায়
পড়েছিলেন যে- পাক বাহিনীকে আজও পড়ানো হয় “কিভাবে উচু স্থান থেকে কেউ এমজি দিয়ে
আক্রমণ করলে কিভাবে তার থেকে রক্ষা পাওয়া যায় ও প্রতিপক্ষকে ঘাঁয়েল করা যায়” সেই
পাঠ। এই শিক্ষা তারা নিয়েছিলো ৮ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে চিংড়ি খান যুদ্ধের নায়ক আঃ
রঊফের কাছ থেকে। যার মাঝারী এমজি ৭টি পাক স্পীড বোট ও ১টি পাক কমান্ডো প্ল্যাটুন
ধ্বংস করে দিয়ে পাক বাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। যিনি একই সাথে
বাঁচিয়েছিলেন ১৫০ জনের প্রাণ!
যুদ্ধের আগে শেষ ছুটিতে বাড়ীতে এসে আঃ রঊফ
তার বড়বোন জোহ্রাকে বলেছিলেন “বুবু সামনে
ছুটিতে এলে তোর জন্য নতুন শাড়ী নিয়ে আসবো” । উনার শাহাদাতের সংবাদ পাওয়ার পর আজ
বহু বছর হলো- উনার বোন জোহ্রা আমার আম্মার সহপাঠী ও বান্ধবী আজও কেঁদে কেঁদে তার
১মাত্র ভাইয়ের সেই কথা স্মরণ করেন। সেই ৭টি স্পীডবোট ও ১ প্ল্যাটুন পাক কমান্ডো
ধ্বংসকারী সেই বীর, সেই ৭ শ্রেষ্ঠ মহাবীরের ১জন বীর বীরশ্রেষ্ঠ
মুন্শী আবদূর রঊফ!
আর কেউই নন, বরং আমার মামা। আমার আম্মার রক্ত সম্পর্কিত খালাতো ভাই। আজ এই বিজয়ের
দিনে তাকে খুবই মনেপড়ছে, মনেপড়ছে ৭ শ্রেষ্ঠ বীরকে। আল্লাহ্ তুমি তাঁদের জান্নাতুল
ফিরদাউসে দাখীল কর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন